৭০ বছর বয়সী রহিমা খাতুন, একজন স্বপ্নজয়ী মা। পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার রাজাপুর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা।মাত্র ২৯ বছর বয়সে স্বামী হারিয়ে চার সন্তান নিয়ে কঠিন স্বপ্ন পূরণে চরম দুঃসময় অতিক্রম করেছেন। সকল চরাই উতরাই পার করে তিনি এখন একজন ‘স্বপ্নজয়ী মা’। সম্প্রতি সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে স্বপ্নজয়ী মা হিসেবে সম্মাননা পাচ্ছেন তিনি। সোমবার (১৩ মে) এ দপ্তরের সদর কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মাননা দেয়া হবে।
নিয়ম করে ফজরের নামাজ আদায় করতেন মা রহিমা খাতুন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া অল্প একটু জমিই তার একমাত্র সম্বল ছিলো। বাড়ির সামনের ফাঁকা খানেক জমিতে সবজি চাষ করতেন। নামাজ শেষ করে তিনি ছুটে যেতেন সবজি খেতে। পানি দেয়া ও পরিচর্যা শেষ করে ছেলে মেয়েদের ডেকে তুলতেন পড়তে বসার জন্য। এরপর দ্রুতই পড়াশোনা শেষ করিয়ে যেতেন জমিতে ফসল পরিচর্যা করতে। ছেলেদের নিয়ে আবাদ করতেন ধান, পেঁয়াজ ও তিলের মত ফসল। নারীর কোমল হাতে কোদাল ধরে জমির শক্ত মাটির আইলও কাটতেন। এরপর দুপুরের খাবার শেষে যখন সবার বিশ্রাম, তখন রহিমা খাতুন বসতেন হাতের কাজ নিয়ে। বুনতেন নামাজের টুপি ও গোসলে গা পরিষ্কারের কাজের খোসা। নিজের হাতে বোনা টুপি বড় ছেলে হামিদের মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করতে দিতেন হামিদকে। ১০ টাকার সুতা কিনে নিজের শ্রমে তৈরি প্রতি টুপি বিক্রি হতো ২৫ টাকায়। এর সাথে জমির ফসল বিক্রি করে সামান্য কিছু টাকায় ভালো খাবার সন্তানদের না দিতে পারলেও দুমুঠো ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা ছিলো তার। বড় চেষ্টা ও স্বপ্নের জায়গা ছিলো ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত মানুষ গড়ার। আজ তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। চার ছেলে সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে রয়েছেন। তাদের মানুষ করার স্বপ্ন এখন আর রহিমা খাতুনের নিদ্রাহীনতার কারণ নয়। এ জায়গা থেকে নিজেকে সফল দাবি করেন তিনি।
দুঃসময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে রহিমা খাতুন বলেন, সারাদিন গৃহস্থলি, হাতের কাজ (টুপি ও খোসা বুনা) ও মাঠের কাজ শেষ করে ক্লান্ত শরীরে হাল ছাড়ার মত অবস্থা হতো। কিন্তু ছেলে মেয়েদের মানুষ করার চিন্তা মাথায় আসতেই লোম দাড়িয়ে যেতো। নুয়ে পড়ার মত শরীরে উঠে বসে সংসার আরেকটু ভালো চালানোর চিন্তা করতাম। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যখন ঘুমাতে যেতো তখন ঢেকিতে ধান ভানতাম। একাই ঢেকি পারাতাম, আবার একাই ধান আউলে দিতাম। কখনো এ ঢেকির শব্দে ছেলেরা উঠে এসে সহযোগিতা করতো।
তিনি জানান, এ কঠিন সময়ে অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। হাতে বানানো টুপি বড় ছেলে হামিদ মাদরাসায় নিয়ে যেতো। সেখানে বিক্রি করতো। মাদরাসার শিক্ষকেরা ছাত্রদের বলে দিতো বাইরে থেকে টুপি কিনবে না, মায়ের বানানো টুপি হামিদ যখন আনবে তখন নেবে। সেই কঠিন সময়ে অনেকেই এরকম সহানুভুতি দেখিয়েছেন।
সফলতা ও সুখের এসময় উপভোগের ব্যাপারে এ স্বপ্নজয়ী মা বলেন, দু’এক বেলা না খেয়েও দিন গেছে। আয়েস করা দুঃস্বপ্ন ছিলো। এখন আয়েস বা সুখের সময় এসেছে, কিন্তু সে সুখ অনুভব করার অবস্থা নেই। সারা শরীরে বিভিন্ন সমস্যা। হাত-পা, কোমর সবখানে ব্যাথা। নানা রোগে ভেতরে অশান্তি ও অস্থিরতা। এই অবস্থায় এখন ভালো খাবারেও স্বাদ অনুভব হয় না। তবে এটি ভেবে আমি শান্তি পাই, আমার ছেলে মেয়েরা মানুষ হয়েছে। ওদের নিয়ে আর চিন্তা নাই।
নিজেদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে মায়ের ভূমিকার কথা জানিয়ে ছেলে হারুনুর রশিদ বলেন, আমার চার বছর বয়সে বাবা মারা যান। জমির আইল কেটে, ফসল চাষ করে, হাতের কাজ করে আমাদের মানুষ করেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখা মায়ের সাহসের পরিচয়। মা কাজের গুরত্ব বুঝতেন। সব সময় আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারটা তার কাছে অধিক গুরুত্বের হলেও কোনোদিন স্কুলে বাদ রেখে আমাদের সাথে নিয়ে ধান কেটেছেন, ফসল মারাই করেছেন। কারণ তখন প্রশ্নটা ছিলো খেয়ে বেঁচে থাকার। আবার অন্য সময়টাতে পড়ালেখার প্রশ্নে কোনো ছাড় নেই। এমন কোনো ভাইবোন নেই পড়ালেখার জন্য মার খাইনি। এই শাসন, ত্যাগ, শ্রম ও সাহসই আজ আমাদের মানুষ করেছে। কৃতজ্ঞ হওয়া ছাড়া মায়ের ঋণ পরিশোধ করার কোনো উপায় নেই।
এ মায়ের তিনটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তারা নিজ পেশাগত জীবনে মায়ের স্বপ্নকে স্পর্শ করেছেন। বড় ছেলে আব্দুল হামিদ। দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে বর্তমানে পাবনা জিলা স্কুলে শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিয়োজিত। মেঝো ছেলে হাফিজুর রহমান ঢাকা কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসার মত স্বাধীন পেশায় রয়েছেন। সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে সমাজে সুনাম রয়েছে তার। সেঝো ছেলে হারুনুর রশিদ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে সরকারের সমাজসেবার গাজীপুর কার্যালয়ে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন এবং ইডেন কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করে মেয়ে ছালমা খাতুন পাবনার প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন।