পাবনার সাঁথিয়ায় ভুয়া রায় তৈরী করে জমি আত্মসাতের চেষ্টা করে ধরা পড়েছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক মনসুর আলম ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসান। তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তদন্ত করে প্রমাণও পেয়েছেন ভূমি কর্মকর্তা। অভিনব কায়দায় জালিয়াতি করা প্রতারক চক্রের বিচার দাবী করেছেন ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, সাঁথিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত রিয়াজ উদ্দিন শেখের ছেলে মনসুর আলম বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক হিসেবে কর্মরত। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ও তার ভাই গ্রামের অন্তত দশ ব্যক্তির সাড়ে ১৮ বিঘা জমি দখলের চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে তারা পারিবারিক ভাবে মামলাও দায়ের করেন।
মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর পাবনা যুগ্ম জজ-২য় আদালতে ওই গ্রামের কয়েকজনের জমিসহ সরকারি বেশকিছু জমি নিজের সম্পত্তি দাবি করে মামলা করেন মনসুর আলমের পিতা রিয়াজ উদ্দিন শেখ। ২০১৬ সালের শেষেরদিকে রিয়াজ উদ্দিন মারা গেলে তদবির না থাকায় ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত। পরে, ঐ মামলাটিতে ২০০৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মনসুর আলমদের পক্ষে আদালত রায় দিয়েছে উল্লেখ করে একটি ভুয়া রায়ের কপি তৈরী করেন মনসুর আলম ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসান। ২০২১ সালের ২০ জুন সাঁথিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে দাখিল করে জমি খারিজের আবেদন করেন মনসুর আলম গং। বিবাদীদের অনেকের নাম আগের ওই মামলায় ছিল না, তাদের নামও ওই ভুয়া রায়ে বিবাদী হিসেবে উল্লেখ করেন। আদালতের ওই ভুয়া রায় দেখে সেটি যাচাই বাছাই না করেই, ২০২১ সালের ৩১ মে মনসুর আলম ও মাহমুদ এ হাসান গংদের পক্ষে জমি খারিজের নির্দেশ দেন তৎকালীন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত এসি ল্যান্ড ও সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জামাল আহমেদ।
জালিয়াতির বিষয়ে অভিযোগ করে, প্রতারিত জমির মালিকরা ভূমি কর্মকর্তার কাছে মনসুর আলমের খারিজ বাতিলের আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে, সাঁথিয়া উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মনিরুজ্জামান চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি পাবনা আদালতের সরকারি কৌশুলীর কাছে রায়ের বিষয়ে মতামত চেয়ে চিঠি দেন। ১৪ মার্চ সরকারি কৌশুলী ওই চিঠির জবাবে জানান ২০০৮ সালে এমন কোনো মামলার রায়ই হয়নি। বরং ওই মামলাটি ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলমান থাকে এবং তদবিরের অভাবে খারিজ হয়ে যায় মনসুরের পরিবারের বিপক্ষে। নথি যাচাই বাছাই করে মনুসর আলমদের দাখিল করা রায়ের কপি ভুয়া প্রমাণিত হলে চলতি বছরের ৩০ মার্চ মনসুর গংদের খারিজ বাতিল করে দেয় ভূমি অফিস।
সম্প্রতি সরেজমিনে সাঁথিয়ার গোপালপুর গ্রামে গেলে মনসুর আলমের এমন জালিয়াতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় এলাকাবাসী। গ্রামের মৃত আছাব আলীর স্ত্রী তহুরা বেগম বলেন, মনসুররা ছোট থাকতে আমার স্বামী তাদের বসবাস করার জন্য জমি দিয়েছিল। কিন্তু এখন সে কি না আমাদের জমি আত্মসাৎ করতে চেষ্টা করেছে। জালিয়াতি করে মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি করেছে। আমি এর বিচার চাই। শুধু আমাদের জমি ই নয়, এই গ্রামের অন্তত দশ থেকে এগারোজনের সবমিলিয়ে সাড়ে ১৮ বিঘা জমি দখল করার চেষ্টা করেছেন মনসুর ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসান।
ভুক্তভোগী নজরুল ইসলাম বলেন বলেন, মনসুর সরকারি চাকুরীজীবী হয়েও এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। রায় জালিয়াতি করে আদালতকেও অবমাননা করেছেন। তার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করছি।
এদিকে, ঘটনা তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্ণীতি দমন কমিশন এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে মনসুর আলমের বাড়িতে গিয়ে তাকে ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসানকে পাওয়া যায়নি। তার মা ফাতেমা বেগম বলেন, তার শ^শুর এ বাড়িতে তাদের রেখে গেছেন। তারপরও ছেলে ভুল করে থাকতে পারে। মানুষেরই তো ভুল হয়। ভুল হলে মাফ করা লাগবি।
তবে, মুঠোফোনে অভিযোগ অস্বীকার করেন মনসুর আলম। তদন্ত প্রতিবেদনে আদালতের রায় জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে জানালে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা কথা, আমি কোনো ভুয়া রায় তৈরী করিনি। কে করেছে তাও জানি না। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তিনি ক্ষমতাসীন দলের জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন নেতাদের সাথে তার সুসম্পর্ক রয়েছে বলে জানান। এক পর্যায়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন মনসুর আলম।
মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাজ্জাদ ইকবাল লিটন বলেন, মনসুর আলম-মাহমুদ এ হাসান গং জালিয়াতি করে নিরীহ মানুষদের হয়রানী করেছেন। জালিয়াতির ঘটনা ধরা পরার পর মনসুর আলম ও তার ভাই মাহমুদ এ হাসানের বিরুদ্ধে পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত-৫ এ মামলা করেছেন সাখাওয়াত হোসেন নামের একজন ভুক্তভোগী।
সাঁথিয়া উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, মনুসর আলী গংদের খারিজ বাতিলের আবেদন তদন্ত করে দেখা যায় তার মধ্যে সরকারি বেশকিছু জমিও রয়েছে। তারা ২০০৮ সালের একটি ভুয়া রায় দাখিল করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন। আদালতের রায় জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর তার খারিজ বাতিল করা হয়েছে। মাহমুদ গংদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা প্রতারণার মামলা করেছেন। সেকারণে সরকার পক্ষে মামলা করা হয়নি।
#
Leave a Reply