এজাহার থেকে প্রভাবশালীর নাম বাদ না দেয়ায় মামলা না নেয়ার অভিযোগ উঠেছে পাবনার আমিনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে। আসামিদের নাম বাদ দিতে রাজি না হওয়ায় ভুক্তভোগীকে থানায় ডেকে জোরপূর্বক অন্য একটি এজাহারে সাক্ষরও নিয়েছেন ওসি। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে পাবনার পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগও করেছেন ভুক্তভোগী আব্দুস সালাম শেখ।
আব্দুস সালাম শেখ জানান, আমিনপুর থানার ভাটিকয়া গ্রামে জমিজমা সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জেরে গত ১ অক্টোবর সকালে প্রতিবেশী বাদশা শেখ, আইয়ুব প্রামাণিক, ইউসুফ আলী, ইদ্রিস, আব্দুল কাদের মাস্টার, সালমাসহ ১০ থেকে ১২ জনের সশস্ত্র দল চাপাতি, বটি, চাইনিজ কুড়াল, রড ও লাঠি নিয়ে সালামের বাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর শুরু করে। এ সময় বাড়ির লোকজন বাধা দিলে হামলাকারীরা তার মেয়ে সোনিয়া, বৃদ্ধা শাশুড়ী শাহাতন বেগম ও স্ত্রী রোকেয়া খাতুনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় সোনিয়ার মাথায় চাইনিজ কুড়ালের কোপ দেয়। শাশুড়ি ও স্ত্রীর চোখ ও মাথায় মারাত্মক আহত করে। গুরুত্বর অবস্থায় তাদের বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরে অবস্থার অবনতি হলে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে এখন বৃদ্ধা শাহাতন প্রায় অন্ধ। স্ত্রী ও মেয়ে সহ অন্যান্য আহতরাও সুস্থ হয়নি।
সালাম জানান, ঘটনার পরদিন থেকে প্রমাণাদি নিয়ে আমি আমিনপুর থানায় এজাহার জমা দিতে গিলে ওসি আনিসুর রহমান আমাকে অভিযোগ থেকে কাদের মাস্টার ও তার স্ত্রী সালমার নাম বাদ দিতে বলেন। আমি রাজি না হলে তিনি মামলা না নিয়ে কোর্টে গিয়ে অভিযোগ করতে বলেন। এরপর ৮ তারিখ পর্যন্ত থানায় ঘুরলেও তিনি কাদের ও সালমার নাম বাদ না দিলে মামলা নেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। ০৯ তারিখ রাতে তিনি আমাকে থানায় ডেকে নেন। একপর্যায়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আমাকে ফোনে ধরিয়ে দেন। একপর্যায়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে কাদের ও সালমার নাম বাদ দিয়ে তার নিজের লেখা এজাহারে জোরপূর্বক সাক্ষর নেন।
সালাম আরো জানান, মামলা নথিভুক্ত না হওয়ায় হামলাকারীরা ওসি তাদের পক্ষে আছে জানিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছে, আমাকে এলাকাছাড়া করার হুমকি ধামকি দিচ্ছে। আমরা গরীব মানুষ। নির্যাতিত হয়েও বিচার পাচ্ছিনা। এ বিষয়ে আমি পুলিশের উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সহায়তা চাই। তাদের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমিনপুর থানার ওসি আনিসুর রহমান বলেন, সালাম থানায় এসেছিলো, অভিযোগ করেছে। মামলা হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেন। পরে একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
এদিকে, আমিনপুর থানার ওসি আনিসুরের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এবারই প্রথম নয়। উৎকোচের বিনিময়ে মামলা না নেয়া, অভিযোগ থেকে আসামিদের নাম বাদ দেয়া, মামলার কার্যক্রম ঝুলিয়ে রাখার বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এসব কারণে আমিনপুর থানা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে বলে স্থানীদের অভিযোগ।
গত ২০ জুন নাটিয়াবাড়ি গ্রামে মনোরমা সূত্রধর (৬৫) নিজ বাড়িতে খুন হন। দূর্বৃত্তরা তার বাড়িতে ঢুকে তাকে খুন করে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনার পর প্রায় পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও পুলিশের গাফলতিতে এখন পর্যন্ত এই খুনের রহস্য উদঘাটন ও কোন আসামি আটক হয়নি বলে নিহতের ছেলে সমীরণ সূত্রধর অভিযোগ করেন।
জুন মাসে জাতীয় দৈনিক প্রভাতের সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা মিঞা সালাহউদ্দিনের আমিনপুরস্থ গ্রামের বাড়িতে ভয়াবহ চুরি সংঘটিত হয়। মিঞা সালাহউদ্দিন এ বিষয়ে মামলা দায়েরের জন্য আমিনপুর থানায় গেলেও ওসি মামলা নিতে গড়িমসি করেন।
আগস্ট মাসে কাশিনাথপুর হাটে কোরবানীর গরু বিক্রি করে বাড়ি ফেরার পথে আমিনপুর থানাধীন সিন্দুরিয়া ব্রীজের কাছে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফেরেন ঢালারচরের আব্দুস সালাম ও ভাটিকয়া গ্রামের সাজেদুল। গত ছয় মাসে আমিনপুরে আরও অন্তত ২৫ থেকে ৩০ টি ভয়াবহ চুরির ঘটনা ঘটেছে। তবে থানা পুলিশ এ নিয়ে কোন আগ্রহ দেখায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা মিঞা সালাহউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, আনিসুর রহমান ওসি হিসেবে যোগদানের পর থেকে এখানে কোন শৃঙ্খলা নেই। থানায় অভিযোগ দিতে গেলে ওসি বলেন, অর্থ-ধন-দৌলত আপনার। এগুলো দেখে রাখার দায়িত্বও আপনারই। আমরা কি আপনার বাড়ি পাহাড়া দিয়ে রাখবো?
আমিনপুর থানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এসআই বলেন, একজন ওসি যদি সারাক্ষণ ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে জনগণের জন্য কাজ করবেন কিভাবে? তিনি অবৈধ বালি উত্তোলন, ট্রলার-স্পিডবোটে চাঁদাবাজি, সিএনজি ইজিবাইকে চাঁদা, প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের সাথে মদ খাওয়া থেকে শুরু করে এমন কোন অপকর্ম নেই যে করেন না। আমরা যারা তার অধীনস্থ, সবাই হুকুমের গোলাম। বাধ্য হয়ে এসব অন্যায় সহ্য করতে হয়।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মাসুদ আলম বলেন, মামলার এজাহারে ভুক্তভোগী কার নাম রাখবে বা বাদ দেবে সে বিষয়ে পুলিশের হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। আনিসুর রহমান কেন মামলা নেননি বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওসির বিরুদ্ধে আমরা লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।