চিকিৎসক, কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দায়িত্বে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় ভেঙে পড়েছে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। জেলার প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের জরুরী ও জটিল চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ রোগীদের। অনিয়মের প্রতিবাদ করলে অপমান এমনকি মারধোরের শিকারও হয়েছেন অনেকেই। এসব ঘটনা হাসপাতালে ওপেন সিক্রেট হলেও অভিযুক্ত চিকিৎসক কর্মচারীরা অস্বীকার করেছেন সব অভিযোগ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি পাবনা জেনারেল হাসপাতালে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন ডাঃ ওমর ফারুক মীর। ঈদ উল ফিতরের আগে হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, সময়মতো উপস্থিত না হওয়া বিষয়টি উল্লেখ করে সহকারী পরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ছুটির পর চিকিৎসক কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা না করার নির্দেশনা দিয়ে লিখিত সতর্কবার্তা পাঠান সহকারী পরিচালক।
এরপরই, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ সাধারণ সম্পাদক হাসপাতালের অর্থপেডিক বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ জাহেদী হাসান রুমীর নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক ওমর ফারুক মীরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে ৮ মে ও ৯ মে অফিস করতে বাধা দেয় চিকিৎসকদের একটি অংশ। নিজ কক্ষের সামনে লাঞ্ছিতও হন সহকারী পরিচালক ডাঃ ওমর ফারুক মীর। পরে, সিনিয়র চিকিৎসকদের সমর্থন না পেয়ে এক পর্যায়ে তালা খুলে দেন তারা। তবে, স্বাচিপ নেতাদের বিরোধীতা ও অসহযোগিতার কারণে এখনো প্রশাসনিক শৃংখলা স্বাভাবিক হয়নি। এর প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা কার্যক্রমেও। ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. জাহেদী হাসান রুমী বলেন, উনি হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে হাসপাতালের সব কাঠামো ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি সদর উপজেলার টেবুনিয়া বাজার এলাকায় সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কামরুজ্জামান নয়নকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এই বিষয়টি তাকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। এতে চিকিৎসকরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলো।
তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাবনা জেনারেল হাসপাতালের একজন সিনিয়র চিকিৎসক জানান, পাবনার স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নাম ভাঙিয়ে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক দীর্ঘদিন কর্তব্যে অবহেলা করে আসছেন। হাসপাতালের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ কোম্পানি থেকে সুবিধা নেন তারা। নিজ চেম্বারে সময় দিলেও হাসপাতালে দায়সারা দায়িত্ব পালন করেন। কখনো বায়োমেট্রিক উপস্থিতি মেশিনে হাজিরা দিয়েই আবারো বাইরে চলে যান। অতীতের কোন সহকারী পরিচালকই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। স্থানীয় অধিবাসী, দীর্ঘদিন একই হাসপাতালে চাকুরি করায় তারাও কারো কথার তোয়াক্কা করেন না। সহকারী পরিচালক ডাঃ ওমর ফারুক মীরও প্রশাসনিক কাজে কৌশলী নন। ফলে, নানা বিষয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে, মঙ্গল ও বুধবার পাবনা জেনারেল হাসপাতালে গিয়েও দেখা মেলে ভোগান্তির নানা চিত্র। মঙ্গলবার সকালে অস্ত্রপচার হওয়া ভাঙা পা নিয়ে ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ডাঃ জাহেদী হাসান রুমীর কাছে ঈশ^রদী থেকে আসেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী রুহুল আমিন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালের স্বাস্থকর্মীর কাছে চিকিৎসকের ফোন নাম্বার চাইলে তিনি মারমুখী আচরণ করেন বলে অভিযোগ রুহুলের।
রুহুল আমিন বলেন, ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে পায়ে অস্ত্রপচারের প্রয়োজন হলে আমি জেনারেল হাসপাতালে ডাঃ জাহেদী হাসান রুমীর সাথে দেখা করি। তিনি নানা অজুহাতে আমাকে ১৭ দিন ঘুরিয়ে অপারেশন করেছেন। ফলোআপ চিকিৎসায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে চেম্বারে দেখা করতে বলেছেন। সরকারের বেতন নিয়ে এই চিকিৎসকরা সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে রোগীদের ভোগান্তি সৃষ্টি করছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন রুহুল।
এদিকে, গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই রুহুল আমিনকে লোক পাঠিয়ে ডেকে নেন ডাঃ জাহেদী হাসান রুমী। পরে তাকে হাসপাতালেই চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে জানান রুহল আমিন।
কেবল তাই নয়, হাসপাতাল কম্পাউন্ডের মধ্যে সম্পূর্ণ অবৈধ ভাবে একটি ওষুধের দোকান পরিচালনা করে একটি চক্র। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স অবৈধ দোকানটি উচ্ছেদে একাধিক বার নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, স্বাচিপ নেতারা এ দোকান থেকে বড় অংকের লভ্যাংশ পান। চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয় ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রয়োজনের দ্বিগুণ ওষুধ ও উপকরণ বেশী দামে কিনতে রোগীদের বাধ্য করেন। পরে তা রোগীদের ফেরত না দিয়ে ওই দোকানেই বিক্রি করে দেন।
আহসান রাজীব নামের এক সেবাপ্রার্থী অভিযোগ করেন, গত কয়েক দিন আগে আমার বাবার হাত কেটে গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসি। স্বাস্থ্যকর্মীরা গজ, ব্যান্ডেজ, ওষুধ সব কিছুই দ্বিগুণ পরিমাণ কিনতে বাধ্য করে। হাত সেলাই করার সময় তারা অতিরিক্ত ওষুধ সরিয়ে ফেলে। ভেতরের কক্ষে ওষুধগুলো দেখে আমি ফেরত চাইলে মারমুখী হয়ে ওঠে তারা। সম্মান বাঁচাতে তা ফেরত না নিয়েই চলে আসি।
সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরমান হোসেন বলেন, এখন পাবনায় এটাই বাস্তবতা, কিছু কিছু অসাধু চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা সেবা জিম্মি। তারা সবসময় সিন্ডিকেট করে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন সেই সরকারের ব্যানার ব্যাবহার করে ক্ষমতার দাপট দেখায়। হাসপাতাল এখন ইন্টার্ন ডাক্তার নির্ভর। এদের দাপট কমাতে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করি।
অভিযোগের বিষয়ে, স্বাচিপ সভাপতি ডাঃ জাহেদী হাসান রুমী বলেন, কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ সত্য নয়, অপারেশনে ব্যস্ত থাকায় অনেক সময় রোগী দেখতে দেরী হয়। সহকারী পরিচালকের অদক্ষতায় হাসপাতালে বিশৃংখলা সৃষ্টি হচ্ছে। ওষুধের দোকানের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ ওমর ফারুক মীর বলেন, পাবনা জেনারেল হাসপাতাল ২৫০ শয্যার হলেও সেখানে গড়ে হাজারেরও বেশী রোগী ভর্তি থাকে। সীমিত জনবল দিয়ে হাসপাতাল পরিচালনায় নানা ধরণের অসুবিধা হয়। আশা করছি চিকিৎসকদের ভুল বোঝাবুঝি দ্রুতই কেটে যাবে। সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করলে সেবার মান বাড়ানো সম্ভব।
Leave a Reply