পাবনায় ঈশ্বরদীর নতুন হাট যেন এক রুশ নগরী! একসময়ের ছোট্ট একটি বাজার বদলে গেছে রাতারাতি। গড়ে উঠেছে সুরম্য দালান, দোকান-পাট, সেলুন, রেস্তোরাঁ এমনকি ব্যস্ত কাঁচাবাজারও। তবে রুশ নগরীর প্রধান যে বৈশিষ্ট্যটি সেখানে আছে, তা হলো সে দেশের ভাষা!
অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই এলাকায় মাঠে-ঘাটে দোকান-পাটে কাজ করা লোকেরাও আজকাল রুশ ভাষায় কথা বলেন, বুঝতে পারেন দিব্যি। এ জন্য অবশ্য তাদের কোনো ভাষা শিক্ষা কোর্স করতে হয়নি। এক দল রাশিয়ানের সঙ্গে ওঠা-বাসা করে অবচেতনেই তারা আয়ত্বে নিয়েছেন ভাষাটি।
বিপরীতে কিছু রাশিয়ানও শিখে গেছেন বাংলা ভাষা। নতুন হাটসংলগ্ন গ্রিন সিটি নামের একটি আধুনিক আবাসিক এলাকায় তাদের বসবাস। কাছাকাছি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দায়িত্বরত তারা।
২০১৩ সালে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। রাশিয়ার সরকারি পরমাণু সংস্থা রোসাটোমের সহযোগিতায় প্রকল্পটির কাজ চলছে। এই প্রকল্পে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা কাজ করছেন।
নতুন হাটে গিয়ে দেখা যায়, রাশিয়ানদের চলাফেরায় বোঝার উপায় নাই এটা বাংলাদেশ নাকি রাশিয়ার কোন নগরী। দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, মাংসের দোকান, কাঁচাবাজার এমনকি সেলুনগুলোতেও বাংলার পাশাপাশি ঝুলছে রুশ ভাষার সাইনবোর্ড। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারীরা রাশিয়ানদের সঙ্গে সারাদিনই রুশ ভাষায়ই কথা বলেন।
বিদেশি এই ভাষাটির বিষয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব আইটির ম্যানেজার মাহবুব হোসাইন বলেন, ‘দুই বছর আগে রুশ ভাষা না শিখেই আমি এখানে চলে আসি। ভাষা না জানাতে প্রথম দিকে রাশিয়ানদের বোঝাতে এবং বুঝতে সমস্যা হতো। এখন তেমন হয় না।’
তিনি জানান, রুশ ভাষায় ‘কাক দিয়ালা’ মানে হলো- কেমন আছ, আর ‘দা কাক দিয়ালা’ মানে- আবার দেখা হবে, এ ছাড়া বেচরম (সন্ধ্যা), জাপ্তা (আগামীকাল), রেমন্তে (ঠিক করতে হবে বা সার্ভিসিং) শব্দগুলো এখন নিত্যদিনই উচ্চারণ করতে হচ্ছে কিংবা শুনতে হচ্ছে।
মাহবুব বলেন, ‘এখানে রাশিয়ান আলেকজেন্ডার, তাজিকিস্তানের আলী- এরা ভাঙা ভাঙা বাংলা বলেন। তারা বন্ধু শব্দ বেশি ব্যবহার করে। কোনো কিছু দেখতে চাইলে বলে- দেখাও বন্ধু। কুশল জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বলে, ভালো আছ বন্ধু?’
নতুন হাটে বিশ্বাস কমপ্লেক্সের মালিক অলিপ বিশ্বাস বলেন, ‘এই মার্কেট রাশিয়ানদের পদাচরণে সব সময় মুখরিত। এখানে আসা বেশকিছু রাশিয়ানের সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হয়। আমি ভাঙা ভাঙা রাশিয়ান ভাষা বলতে পারি। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে তারাও। এর মধ্যে রাশিয়ার রুমা, ম্যাক্স ও উজবেকিস্তানের মেরিনা ভালো বাংলা বলতে পারে। তারা আমাদের সঙ্গে মিশে মিশে বাংলা শিখেছে। ভাই কেমন আছ, ভালো আছি, ধন্যবাদ এই কথাগুলো তারা খুব স্বাভাবিকভাবে উচ্চারণ করে।’
নতুন হাটে ‘রুশ কায়া মধ’ বা ‘রুশ ফ্যাশান’ নামের একটি দোকান রাশিয়ানদের কাছে খুব জনপ্রিয়। এর ম্যানেজার আইয়ুব আহমেদ জানান, রুশ ভাষা শিখতে ঢাকায় একটি কোর্স করলেও ভাষাটি পুরোপুরি আয়ত্ত করেছেন নতুন হাটে এসে।
তিনি আরও জানান, দোকানের পণ্যগুলোকে নিজেদের উচ্চারণে তারা ক্রসপ (জুতা), বাতিংকি (বুট জুতা), ফুটবলকা (টি-শার্ট), রুবাস কা (শার্ট), কোটকা (জ্যাকেট), স্তানি (প্যান্ট) বলে ডাকেন। আর বাংলায় তারা কেমন আছ বন্ধু, ভালো আছি, নতুন কালেকশন কি আছে, দাম কম রাখবে কি না, ডিসকাউন্ট দিতে হবে- এই কথাগুলো তারা প্রায়ই উচ্চারণ করেন। তিমুর নামের এক রাশিয়ান খুব ভালো বাংলা বলতে পারেন বলেও জানান মাহবুব।
ফল ব্যবসায়ী মানিক জানান, আগে তিনি প্রকল্পের ভেতরে কাজ করতেন। দেড় বছর ধরে নতুন হাটে ফলের ব্যবসা করছেন। তার দোকানে রাশিয়ানদের আনাগোনাও বেশি।
মানিক বলেন, ‘একসঙ্গে কাজ করে আর ফল বিক্রি করতে গিয়ে রুশ ভাষা অনেকটাই আয়ত্ত করে ফেলেছি। এখানে ব্যবসা করতে ভাষাগত কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।’
অষ্টম শ্রেণির ছাত্র বিশাল প্রামাণিক নতুন হাটেরই স্থানীয়। বাবা চাচার সবজি দোকানে স্কুল ছুটির পর বসে সে। এতেই রুশ ভাষা এখন তার বেশ ভালোই আয়ত্তে।
বিশাল বলে, ‘ভাষা শিক্ষার কোর্স না করেও আমি রাশিয়ান ভাষা বুঝতে এবং বলতে পারি। তারা আলুকে বলে কারতোস্কা, রসুনকে শিষনোক, বেগুনকে বাগলাডান, টম্যাটোকে পানিদো, শশাকে আগুরছি, গাজরকে মারকোস্কা, কাঁচা মরিচকে পেরিচ, পেয়াজকে লুক, মুলা সবজিটিকে রিজিসতা, লেবুকে নাইম এবং আদাকে ইমতির।’
কথা বলতে বলতেই দোকানে এক রাশিয়ান ক্রেতা চলে এলে তার সঙ্গে রুশ ভাষায় কথোপকথন আর সবজি বিক্রিতে ব্যস্ত হয়ে যায় বিশাল।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘এখানে বাংলাদেশিদের যেমন রয়েছে রাশিয়ান ভাষা শেখার আগ্রহ, তেমনি রাশিয়ানরাও বাংলা ভাষা শিখতে চায়। ভাষা শিখতে এখানে কোনো কোর্স করতে হয় না।’
Leave a Reply