মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০২৩, ০১:৩৫ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ
অফিস অটোমেশন সিষ্টেমের উদ্বোধন, কাগজবিহীন অফিস হতে চলেছে পাবিপ্রবি বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে পাবিপ্রবিতে আলোচনা সভা পাবিপ্রবিতে প্রথমবর্ষের গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার সকল আয়োজন সম্পন্ন আন-নাসর রমাদান কুইজ ও কর্জে হাসানা কার্যক্রম শুরু পাবনায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাংলা নতুন বর্ষবরণ রূপপুর প্রকল্পের গাড়ি চালক সম্রাট হত্যা মামলার মূলহোতা মমিন গ্রেফতার নিখোঁজের দুইদিন পর রূপপুর প্রকল্পের গাড়িচালকের মরদেহ উদ্ধার বাউয়েট এ, “সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রম” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত নিখোঁজের দুইদিন পর যমুনা নদী থেকে কিশোরের বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার চরতারাপুরে বালু মহলে পুলিশের ওপর চেয়ারম্যানের লোকজনের হামলা, সরঞ্জাম জব্দ

বরেণ্য শিক্ষাবিদ মনোয়ার হোসেন জাহেদী স্মরণে-কৃষ্ণ ভৌমিক

পাবনামেইল টোয়েন্টিফোর ডেস্ক
  • প্রকাশিত Wednesday, 7 October, 2020
Pabnamail24
পাবনার শিক্ষা- সাংস্কৃতিক জগতের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মনোয়ার হেসেন জাহিদী ইহজগত ছাড়লেন। ১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকালে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শ্রদ্ধাভাজন আমিনুল ইসলাম খান ফোনে এ দুসংবাদটা জানালেন। জেলা ফরিদপুরে গিয়ে ২দিন আগে তার অসুস্থ্যতার খবর জেনেছিলাম।
মন স্থির করেছিলাম পাবনায় গিয়ে ফোন করবো। কিন্তু জার্নির ক্লান্তিতে রাতে আর যোগাযোগ করি নি। সকালে তাই তার মৃত্যুর খবরে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মনটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। সামাজিক মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে খবরটি পোস্ট করি।এ পোষ্টে মৃত্যু সংবাদের সাথে প্রতিক্রিয়া লিখি- আমাকে আর কোন দিন ফোনে কেও বলবেন না এ তথ্য লাগবে,এটা লিখেছি ওটা লিখবো।
সামাজিক মাধ্যমে এ পোস্টের কয়েক মিনিটের মধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ সাংবাদিক কলামিস্ট রণেশ মৈত্রের ফোনে প্রিয়জন হারানোর শোকার্ত আকুতিতে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। মনে হলো যেন আপনজনকেই হারালাম। এরপর একের পর এক ফোনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে উঠলাম।মনোয়ার হোসেন জাহিদী যে নেই এটা যেন কিছুতেই মন মানছে না।তার পরেও মানতে হচ্ছে এটাই যে মানুষের নির্ধারিত।তাই আজ স্মৃতিচারণমুলক লিখতে বসে অনেক স্মুতিই যেমন পীড়া দিচ্ছে তেমনি মনে অপরাধবোধ ও জেগে উঠছে।
মনোয়ার হোসেন জাহিদী আমার শিক্ষক ছিলেন না।তার সহজ সরল কথার মাধুর্যতাসহ মিষ্টি ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়ে তাকে স্যার বলে সম্বোধণ করতাম। তিনি ও যেন আপন মনে প্রাণখুলে কথা বলতেন।আর মনোয়ার হোসেন জাহিদীর আর আমার শিকড় সুজানগর উপজেলায় হওয়ায় সম্পর্কের গভীরভা যেন একটু বেশিই মনে হতো। তিনি সুজানগর উপজেলার গজারিয়া গ্রামে ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি গজারিয়া গ্রামেরআব্দুস সাত্তারের ছেলে।তার সম্পর্কে কি বলবো? তিনি ছিলেন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, শিকড় সন্ধানী লেখক,কবি, গবেষক ও সুবক্তা। তাকে আবার অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর ও বলা যায়। শিক্ষাকতায় ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সার্থক শিক্ষক।তার বাচনভঙ্গি ও সাবলিল বক্তব্য ক্লাসের ছাত্রদের যেন যাদুর মতো আবিষ্ট করে রাখতো।আর সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন নির্লোভ সাদাসিধা দরদী মনের সংস্কৃতিবান আদর্শবান মানুষ।
তিনি সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ, পাবনা সরকারি মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে খন্ডকালীন অধ্যাপনা ও করেছেন।পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতে দুই যুগ সম্পাদক ছিলেন। পাবনা শিল্পকলা একাডেমির সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি নিরলস গবেষণাসহ সাহিত্য সাধনায় নিজেকে যেন উজার করেছিলেন।তার প্রকাশিত বই হচ্ছে: অনন্ত ঘুমের দেশে, শতাব্দীর ছায়াপথে এডওয়ার্ড কলেজ, শতাব্দীর বিদ্যাপীঠ রাধানগর মজুমদার একাডেমী, বাংলা ছন্দের পাঠশালা, রবীন্দ্রনাথ : কবিতায় ফুল, মাকে মনে পড়ে, স্বর্গের দুয়ারে যাত্রা এবং পাবনার কৃতীজনের কথা।
তিনি পাবনা সরকারি মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে থেকে অবসরের পর গবেষণাসহ বই লেখা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।কিন্তু তার একমাত্র কন্যার জামাই বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়ায় তার জীবণ মারাত্মক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।জামাই উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দিপু ২০১৮ সালের ২৩ নবেম্বর টাঙ্গাইলের মধুপুরে প্রশিক্ষণ জেট ফাইটার বিধস্ত হয়ে মারা যান। ১ মেয়ে ও ১ কন্যার পিতা আরিফ আহমেদের মৃত্যুতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। করোনা শুরু থেকে তিনি ঢাকাতেই ছিলেন।
গত কোরবাণির ঈদের আগে তিনি পাবনায় ফেরেন।করোনাকালিণ ঢাকায় থাকাকালে মনোয়ার হোসেন স্যার প্রায়ই পাবনার সেকাল একালের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে তার সর্বশেষ বই লেখার প্রস্তুতি নিয়ে শেয়ার করতেন।।তিনি ৬০০ পৃষ্ঠার এ ডকোমেন্টারী বইয়ের জন্য দীর্ঘদিন ধরে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করছিলেন তা আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম।
করোনায় ঢাকায় আটকা পড়ায় তিনি মাঝে মধ্যেই হা হুতাশ করতেন তার এ বই লেখার কাজ স্তিমিত হওয়ায়। তিনি প্রায় রাতেই ফোনে জানতে চাইতেন পাবনার আর কি ঐতিহ্য তার বইতে সন্নিবেশিত করা যায়। একরাতে আমার শোনা এক গল্প স্যারকে বললাম- পাবনায় এক সময় সীতানাথ বাবু নামে এক গরিবের চিকিৎসক ছিলেন।তিনি প্রত্যন্ত চরে যেতেন রোগি দেখতে।
তিনি মাডগাডবিহীণ বাইসাইকেল নদীর ধারে ফেলে রেখে গামছায় নদী সাঁতরিয়ে রোগির বাড়ী যেতেন। সাইকেল যেভাবে তিনি ফেলে যেতেন সেভাবেই থাকতো কারণ সবাই তার সাইকেল চিনতো। রোগি দেখা হলে রোগির পরিবার যদি বলতেন বাবু আমাদের টাকা দেয়ার ক্ষমতা নেই বাড়ির লাউ আর কিছু সবজি রেখেছি আপনি নিয়া যাবেন ।
তিনি সানন্দে বলতেন আরে আমি কি টাকা চাচ্ছি দে তোরা যদি লাউ নিলে খুশি হস তো দে।আমার একথা চুপচাপ শোনার পর স্যার হেসে বললেন আরে আমিতো তাঁর উপর লিখেছি। শুধু তাই নয় তার ছবিও যোগাড় করেছি। আর একদিন স্যারকে বললাম আপনার কি ডাক্তার অনিল ঘোষের কথা মনে আছে। রাধানগরের বীরেন ডাক্তারের কথা মনে আছে।
বীরেন বাবু ও গরিবের ডাক্তার ছিলেন।তিনি গরিব রোগির পথ্য পর্যন্ত কিনে দিতেন ।স্যার হেসে বললেন হ্যাঁ আমি লিখেছি।তিনি অনিল ডাক্তারের ছেলের বাসুদেব ঘোষের বিষয়ে জানতে চাইলেন। আমি বললাম বাসু কলকাতার লেকটাউনে থাকে মেডিসিনের ব্যবসা করে। স্যার আমাকে বললেন বাসুর সাথে যোগাযোগ করে অনিল ডাক্তারের ছবি এনে দিতেহবে। আমি বললাম করোনা গেলেই কলকাতায় যাবো আর বাসুর সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিলো অসুবিধা হবে না।
তার পর তিনি তার বইয়ের জন্য যেসব ছবি সংগ্রহের কথা জানালেন আমি তাজ্জব বনে গেলাম। তিনি কলকাতাপ্রবাসী বেশ খ্যাতনামা কয়েকজনের দুষ্পাপ্য ছবি সংগ্রহেরও কথা জানালেন।একদিন তিনি বনমালী মঞ্চ নাটকের খ্যাতিমান অভিনেতা ত্যাজেন চক্রবর্তিরও ছবি সংগ্রহের কথা বললেন।
তিনি আরেক অভিনেতা কলকাতাপ্রবাসী শ্যামল কর্মকারের ছবি সংগ্রহ করে দেয়ার অনুরোধ করলেন। তাকে বললাম স্যার আমি শ্যামলদাকে চিনি কলকাতার ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার হাসপাতালের সামনে শ্যামল কর্মকারের গেস্ট হাউজ আছে।করোনা গেলে বর্ডার চালু হলেই আমি কলকাতায় গিয়ে ছবি সংগ্রহ করে ওখান থেকেই পাঠাবো।
আর একদিন বললেন আমাকে পাবনা প্রেসক্লাবের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের তালিকা করে দিতে হবে। আর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহমেদ উল হক রানার বাবা ডাক্তার মাকসুদ উল হকের ছবি সংগ্রহ করে দিতে হবে।
আমি বললাম স্যার আপনি পাবনায় আসুন আমি দিতে পারবো।একরাতে তিনি বললেন আমি বই লিখতে প্রয়োজনে বার বার বিভিন্ন লোকের সাথে ফোনে কথা বলি। অনেকে হয়তো বিরক্ত হয় কিন্তু আমি কি ব্যক্তিগতলাভের জন্য বা টাকা পয়সার জন্য ফোন করি না।
পাবনায় আসার পর তিনিও নিয়মিত যোগাযোগ করেতে পারেননি আমার ও অপারগতা ছিলো। প্রায় ১ মাস পর রাতে ফোন করে স্যার বললেন ঢাকাতে থাকাটাই তো ভালো ছিলো তাও প্রায় দিনই কথা হতো। কিন্তু পাবনাতে এসে যে দেখা হচ্ছে না।তার পরে তিনি একদিন নেটে ফোন দিয়েছিলেন তখন আমি বুঝতে পারিনি।
বাসায় গিয়ে তা নজরে এলে চেষ্টা করেও স্যারের সাথে কথা বলতে পারলাম না। তার পরে মেসেজ লিখলাম স্যার ২-১ দিনের মধ্যেই প্রেসক্লাবের পুরো তথ্য নিয়ে দেখা করতে পারবো। সাক্ষাতে সব আলাপ হবে ভালো থাকবেন।
এটিই আমার শেষ মেসেজ । স্যারের সাথে আর সাক্ষাতের সুযোগ হলো না।মৃত্যু কেড়ে নিলো অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন জাহিদীকে। আমরাও হারালাম একজন বরণ্য সাহিত্যিক অধ্যাপক গবেষক মহৎ প্রাণের মনোয়ার হোসেন জাহেদীকে। শুধু এইটুকু বলতে পারি এ অভাব কোনদিন পুরণের নয়।
আমি স্যারের আত্মার শান্তি কামনা করছি।আমি মনোয়ার হোসেন জাহিদীর স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে সমবেদনা জানাই। পরিশেষে তার পরিবারের কাছে বিনীত অনুরোধ রাখতে চাই স্যারের অপ্রকাশিত বইটি যদি প্রকাশে উদ্যোগ নিতেন তাহলে তিনি তার সৃষ্টিশীলতায় প্রজন্মান্তরে বেঁচে থাকতেন মানুষের মনে।। আর এ জন্য যদি আমাদের কোন সহায়তার প্রয়োজন হয় তবে আমরা প্রস্তুত ।
লেখক: কৃষ্ণ ভৌমিক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও সাংবাদিক, দৈনিক জনকন্ঠ।

শেয়ার করুন

বিভাগের আরো খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!