পদ্মা ও যমুনার চরে নিরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন নদীভাঙা মানুষেরা। এক সময় যে নদী ছিল তাদের দুঃখের কারণ, সে নদীর বুকে জেগে ওঠা চরই এখন বদলে দিয়েছে তাঁদের ভাগ্য। ভাঙনকবলিত মানুষ ফলাচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের ফসল। এর সঙ্গে গড়ে তুলেছেন ছোট ছোট গোখামার। এসব খামারের দুধ, গোশত বদলে দিচ্ছে তাদের ভাগ্য।
পাবনা বেড়া উপজেলার নদী ভাঙনে নিঃস্ব শতশত পরিবারের এক সময় বসতভিটা পর্যন্ত ছিল না। উপজেলার পদ্মা-যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরে বসতি গড়ে তোলেন। তাঁদেরই একজন আলম প্রামাণিক উপজেলার চরনাকালিয়া গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। অন্যের জমিতে কামলা খেটে ও বর্গাচাষি হিসেবে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। এক বেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা জুটত না। ১০ বছর আগে আলম প্রামাণিকের অবস্থা ছিল এ রকম। আর আজ? আজ তাঁর ঘর-বাড়ি, জমিজমা সব হয়েছে। এলাকায় তিনি এখন অন্যতম এক সচ্ছল মানুষ। এই কয়েক বছরে সব মিলিয়ে তাঁর সম্পদের পরিমাণ অন্তত ১০ লক্ষ টাকা।
কোন আলাদিনের চেরাগের বদৌলতে তাঁর ভাগ্যের এ পরিবর্তন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার ভাগ্য বদলায়া দিছে গরু। এনজিওর ঋণে দুইড্যা বকনা বাছুর কিনছিল্যাম। আইজ আমার গোয়ালে ছয়ডা গাভি। দৈনিক দেড় মণ দুধ পাই। এহন গরু পালনই আমার একমাত্র পেশা। আমার গরুর খাবারেরও কোন অভাব হয় না চরে বিভিন্ন ধরনের ঘাস বুনে তা পুরন করি।
আলম প্রামাণিকের মতো শুধুমাত্র গরুতে ভাগ্য বদলের এমন অসংখ্য কাহিনী শুনতে পাওয়া যায় পদ্মা-যমুনার চরাঞ্চলে গিয়ে।
যমুনা নদীপাড়ের নাকালিয়া বাজারটি বেড়া, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার অন্তত ৪০টি চরের বাসিন্দাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। এই বাজারের ঘাটে বসে কথা হচ্ছিল চরের বাসিন্দা ও নাকালিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বশির মিয়ার সঙ্গে। তাঁর মতে ১৫ বছর আগেও চরে এত গরু ছিল না। ওই সময় হাতে গোণা কিছু গৃহস্থ উন্নত জাতের গাভি এনে পালন শুরু করেন। কেউ কেউ আবার হাট থেকে ষাঁড় বাছুর কিনে এনেও পালন করতে থাকেন। গাভির দুধ থেকে ভালো আয় আর গরু মোটাতাজা করা থেকে ব্যাপক লাভ করতে দেখে গরু পালনে আগ্রহীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। এভাবে এখন চরের প্রায় সব বাড়িতেই গড়ে উঠেছে গরুর খামার। বশির মিয়া আরও বলেন, ‘চরে গরু পালনের নীরব বিপ্লবের শুরু ১৫ বছর আগে হলেও বছর চারেক ধরে এই বিপ্লব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। গরুবিপ্লবে চরের অন্তত ৯০ ভাগ মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে।
বেড়া উপজেলার চরনাকালিয়া গ্রামের আওলাদ হোসেন জানান, মূল এলাকায় সারা বছর গো-খাদ্য কিনে গরুগুলোকে খাওয়াতে হয়। সেখানে কাঁচা ঘাস কম পাওয়া যায় বলে খর-ভুষির ওপর গরু পালনকারীদের বেশি নির্ভরশীল থাকতে হয়। কিন্তু চরে এর ঠিক উল্টো অবস্থা। বর্ষা মৌসুমের মাস চারেক ছাড়া বাকি প্রায় আট মাস চরে পাওয়া যায় প্রচুর কাঁচা ঘাস। আর এই ঘাস চরবাসীরা সংগ্রহ করেন একরকম বিনামূল্যেই। ফলে গরু পালনের বাৎসরিক খরচ তুলনায় আনলে চরবাসীদের খরচ সমতল এলাকার পালনকারীদের তুলনায় প্রায় অর্ধেকেরও কম। এর ওপর চরবাসীরা কাঁচা ঘাস বেশি খাওয়ান বলে তাঁদের গাভিগুলোর দুধ দেয়ার ক্ষমতা সমতল এলাকার গাভির চেয়ে বেশি।
পাবনা-সিরাজগঞ্জের কয়েক উপজেলা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং দুধ, প্রাণ, ফার্মফ্রেস, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরিসহ প্রায় ২০টি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে বাজারজাত করে আসছে। এই দুধের অন্তত ৬০ হাজার লিটারই চরের বলে স্থানীয় প্রাণীসম্পদ কার্যালয় ও কয়েকটি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া চরবাসীর চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর দুধ যাচ্ছে উপজেলার হাট-বাজারসহ ছানার কারখানা ও মিষ্টির দোকানে।
বেড়া উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা স্বর্নালী জাহান পান্না বলেন, ‘গরু পালন করে চরের মানুষ গত একযুগে যে সাফল্য পেয়েছে তা সত্যিই বিষ্ময়কর। উপজেলার চরগুলোর মধ্যে চরনাকালিয়া, চরনাগদা, দক্ষিণ চরপেঁচাকোলাসহ অন্তত ২৫টি চরে বলা চলে গরুবিপ্লব ঘটে গেছে।
Leave a Reply